ফুল-মনিরে ওরে ও ফুলমনি, এতো রাতে কই গেলি মা। ফিরে আয় মা আমার । গভীর রাতের নৈশব্দ ফালা ফালা করে মাহিয়ামায়ের প্রাণের ডাক তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে মন-খুশী গ্রামের সব ঘুমন্ত মানুষের আরাম নিদ্রা ঘুচিয়ে দিল । তবে কিনা মন-খুশী গ্রামের মানুষ ভারি ভালো তারা রাগ কাকে বলে জানেনা। তাইআবার প্রতিরাতের মতন কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুরে শোয়।
গভীর রাতে ফুলমনি প্রায়শই মায়ের কোল ছেরে পা টিপে টিপে রাতের আকাশের তলায় ঘুরে ফিরে নীল পাখি-সোনা কে খোঁজে। নীল পাখি-সোনা, সে আবার কি !
তাহলে বলি শোনো নীল পাখির গল্প।
আজ থেকে তের বছর আগে শীতের এক হাড়-জমানো ভোরে ছোট্ট শান্ত মন-খুশী গ্রামের মানুষ এক সুতীব্র পাখির ডাকে ধড়ফড় করে শয্যা ত্যাগ করে গায়ে গরম চাদর চাপিয়ে
খোলা আকাশের তলায় এসে দাঁড়াল। এদিকে তাকায়। ওদিকে তাকায় কিন্তু কিছুই দেখতে পায়না ;কোনও রকম পাখি বা জানোয়ার তো নয়ই। তবে যে সবাই শুনেছে নীল-পাখির ডাক।
হঠাত্ সবাই গ্রামের প্রান্তসীমায় বিশাল শিমুল গাছের তলায় কিছু একটা দেখতে পায়।
গাছের তলায় ছেঁড়া কাপড়ে মোড়া ক্ষীণকায় এক ছোট্ট বাচ্চা শীতে নীল হয়ে পরে ছিল আর অতি ক্ষীণ স্বরে ওঁয়া ওঁয়া করে আওয়াজ করছিল ।
আহা রে, কার এমন কঠিন প্রাণ, দুধের শিশুটি কে শীতের রাতে, খোলা মাঠে,জন্তু জানোয়ারের মাঝে ফেলে গেছে।
মাহিয়া বলে ওঠে এ মেয়ে আমার এ ভগবানের দান । ফুলের মত সুন্দর তুলোর মত নরম পাখীর বাচ্চার মতন উষ্ম এই মেয়ের নাম দিলাম ফুলমনি । আজ থেকে আমি তোর মা হলাম রে সোনা আমার মানিক আমার। কে বলে তুই ফেলনা, তোর কেউ নেই ।এই গ্রাম জোরা তোর আপজন, আর আমি তোর মা।জন্ম-দিইনি বটে তবে তোকে আমি এত ভালবাসা দেব তুই কোনও দিন ও মায়ের অভাব পাবিনা ।
সবাই বলে ওঠে ফুলমনি ফুলমনি, আজ থেকে ফুলমনির মা আমাদের সকলের মা মাহিয়া মা। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক।
মাহিয়া বড়ই দুঃখী মানুষ বড় একলা তার না ছিল ছেলে না কোনও মেয়ে আর সে জন্য তাকে ছেড়ে চলে গেছে তার মরদ । আজ ফুলমনিকে বুকে নিয়ে খুশীর জোয়ারে ভেসে গেল সকল দুঃখ সকল কষ্ট।
সন্তানহীন মাহিয়া আজ সারা গ্রামের আদরের মা। আদরে আদরে বড় হয়ে ওঠে লিলি ফুলের ডালের মত ছিপছিপে ফুলের মতন নরম হাসি খুশী সোনার মেয়ে ফুলমনি। মাহিয়ামায়ের এখন আর দম ফেলার সময় নেই। মেয়েকে নাওয়ানো খাওয়ানো শোয়ানো কত কাজ। মেয়ে যতো বাড়ে ততোই বাড়ে তার দৌরান্ত্য । দল বল নিয়ে এর গাছের কাঁচা পেয়ারা তার বাগানের আম, জাম , লিচু সাবাড়করে। নালিশ পেয়ে মাহিয়ামা ছুটে মারতে যায় কিন্তু নাগাল পায়না, কেমন করেই বা পায়, মেয়ে তো ততক্ষণে মগডালে উঠে বসে আছে ।
তোর কি কোনও ভয়ডর নেই, সরু ডালে বসে আছিস যে ভারি, ভেঙে পড়বি যে, হাত পা ভাঙবে , শিগগিরই নাম বলছি।
নামলে তুমি মারবে আমি নামব না। এ তো ভারি জ্বলা দেখছি তবে থাক বসে রাগ করে পা দাপিয়ে মাহিয়া মা ঘরে যায় কিন্তু থিতু হতে পারেনা। বেলা বাড়ছেমেয়ের আমার খিদে পেয়েছে, আর না পেরে আবার গিয়ে ডাক দেয়- আমার ঘাট হয়েছে মা এবারে গাছ থেকে নাম ঘরে গিয়ে স্নান করে খাবি আয়, কত বেলা হল খেয়াল আছে!
না নামব না, নামলে তুমি মারবে ।
মারবনা নেমে আয় ;
ঠিক তো !
হ্যাঁরে হ্যাঁ মারবনা
তিন সত্যি কর
মারবনা মারবনা মারবনা হয়েছে !
মেয়ে নামলে গায়ে পায়ে হাত বুলিয়ে দেখে কোথাও কোনও কাটে ছড়েনি তো। আহ্লাদী মেয়ে মায়র হাত ধরে ঘরে ফেরে ।
কিন্তু নীল পাখি-সোনার গল্প?
সে ভারী এক আজব পাখি । পাখির গাড় নীল রঙের বিশাল-দুটি পাখা, তাতে আবার লাল বুটি । পাখির লম্বা গলায় ময়ূর কণ্ঠী রঙ , গভীর কাজল কাল চোখ যেন কোন এক অচিন-পুরের পাখি। কে দেখেছে সে পাখি , না কেউ দেখেনি,কিন্তু তবু যেন দেখেছে, দেখেছে মনের আয়নায়।
নীল পাখির গল্প মন-খুশী গ্রামের এক অতি প্রাচীন কাহিনী, বহু বছর ধরেগ্রামবাসীরা শুনেছে পাখির কথা, বাবার কাছে, মায়ের কাছে, দাদু বা দিদার কাছে ।নীল পাখির অনেক ক্ষমতা, সে বাতাসের আগে ওড়ে, অসীম শক্তি ধরে,যখনই কেউ বিপদে পরে তখনি সাহায্যের ডানা মেলে ধরে। এক কথায় সে মন-খুশী গ্রামের রক্ষাকবচ । কিন্তু তাকে কেউ দেখেনি শুধু মাত্র সাহায্য পেয়েছে।
শোনা যায় পাশের গ্রামে এক জোরা পাখী সবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে, চাল, ডাল, গাছের পেয়ারাটা, জামটা ঠুকরে খেত । তাদের গাড় নীল রঙের বিশাল-দুটিপাখা, তাতে আবার লাল বুটি । পাখির লম্বা গলায় ময়ূর কণ্ঠী রঙ , গভীর কাজল কাল চোখ । তবু কলাটা মুলোটা খেয়ে বেড়ায় বলে গ্রামবাসীর ভারি রাগ। এক দিন মা পাখি ডিম পাড়ল, সাদা ডিম নয়, ডিম গুলি লাল, নীল আরময়ূর কণ্ঠি রঙের । মা পাখি ডিমে তা দেয়, আর বাবা পাখি খাবারের খোঁজেউড়ে বেরায় ।এক দুপুরে গ্রামবাসী দেখে ডিম রেখে মা-পাখি কি জানি কোথায় গেছে । আর পায় কে, ঢিল ছুঁড়ে তারা সব কটি ডিম দিল ভেঙ্গে। সেই শব্দ পেয়ে মা-পাখি উড়ে এলো, তাকেও ছাড়ল না গ্রামের লোকেরা , মার, মার মার শব্দে তেড়ে এলো সবাই। সে সময় গ্রামের রাস্তা ধরে মন-খুশি গ্রামের দু-জন লোক যাচ্ছিল । তারা তো হাঁ হাঁ করে উঠল, এ কি কর, এ কি কর, এ তো পাপ, জীব হত্যার পাপ। মায়ের বুক থেকে তার ছানাদের কেড়ে নেবার পাপ। তারা দু-জনা মা-পাখিকে নিয়ে এসে অনেক শুশ্রসা করল তবু তার প্রাণ বাঁচান গেল না। সবাই বললে মায়ের বুক থেকে তার ছানা কেড়ে নিলে, মা কি আর বাঁচে।
তো তার পর থেকে মন-খুশী গ্রামে নীল পাখি-সোনা আসে যায় তবে তাকে দেখা যায় না। গ্রামের কোনও কেউ বিপদে পড়লে পাখি সবাই কে সজাগ করে দেয়। এ সবই শোনা কথা । তবু তারা সত্যি মানে ।
ফুলমনি রাতবিরেতে নীল পাখির খোঁজে গ্রাম চষে ফেলে কিন্তু কেন বল তো;কারণ নীল পাখির দেখা পেলে মায়ের কথা জানবে, কে তার মা, কেমন দেখতে, কেনই বা তাকে ছেরে গেল।
মাহিয়ামা দুঃখ পাবে তাই রাতের বেলা যখন সব্বাই ঘুমের দেশে তখন পা টিপে টিপে ঘরের বার হয়। অতটুকু মেয়ের ভয় নেই ডর নেই, তাকে যে জানতেই হবে মায়ের ঠিকানা।
ফুলমনি তখন সবে সাতে পা দিয়েছে, গরমের এক ভর দুপুরে পোষা বিড়াল ছানা কোলে পুকুর পাড়ে আপন মনে খেলছে দুম করে কোলের পুষি পড়ল গিয়ে পুকুরের জলে। আর দেখে কে, পুষিকে বাঁচাতে ঝাঁসির রানি ঝপাং করে জলে লাফ।
তখনি নীল পাখি ডাক দিল তীব্র গভীর আর বিপদের ডাক। সবাই এসে দেখেঅচেতন প্রায় ফুলমনি পুকুর পাড়ে, জল খেয়ে পেট ফুলে ঢোল ।সে যাত্রা পেটের জল বার করে ফুলমনি নীল পাখির দয়ায় প্রাণে বাঁচল। কিন্তু আর নয়, দুষ্টু চঞ্চল মেয়েকে বাগে আনতে মাহিয়ামা তাকে গ্রামের স্কুলে ভরতি করে দিল । অবাককাণ্ড পড়তে বসেই অমন দুরন্ত মেয়ে একদম ঠাণ্ডা ।গ্রামের স্কুল মাষটারমাহিয়ামাকে ডেকে বললেন, দেখ মা তোমার মেয়ের খুব ভাল মাথা, যা শেখাইএকবারেই শিখে যায়। অর লেখা পড়ায় খুব মন, এখানে যতটুকু শেখানরশিখিয়েছি, এবার ওকে শহরের স্কুলে দাও।
কিন্তু সে যে অনেক দূরে মাষ্টার আমার এই টুকুন মেয়ে একা যায় কি করে।
না মা না, এই তো শিমুল গাছ বড় মাঠের শেষে , মন-খুশী গ্রাম ও শেষ , সেই সীমানা ছাড়িয়ে দুটো বাড়ি, প্রথম বাড়িটাই তো মেয়েদের স্কুল বাড়ি আর পরেরটা ছেলেদের।
কিন্তু আমি তো মুখু মানুষ, কেমন করে মেয়েকে নিয়ে যাই বলতো?
সে তোমাকে ভাবতে হবেনা কো, আমি সামনের সোমবারে ফুলমনি কে নিয়ে ভরতি করে আসব , ফুলমনি আমাদের গ্রামের গৌরব । তো গ্রামের ফুলমনিশহরের স্কুলে ভর্তি হল। কিছুদিনের মধ্যেই ফুলমনি সবার চোখের মনি হয়ে উঠল। সব দিকে সে সেরা, লেখা পড়া, খেলা ধুলা, ফুলমনি সবার প্রথম। ধীরে ধীরে ফুলমনি বেড়ে ওঠে আর বেড়ে ওঠে তার বুদ্ধি । স্কুলে যাবার তর সয়না তার। আরে সবুর কর একটু; দুটো মুখে দিয়ে যা মা, সেই কখন দুপুর গড়িয়েফিরবি।কিন্তু কে কার কথা, মেয়ে ততোক্ষণে দৌড়ে মাঠ পাড় করে দিয়েছে।
ফুলমনি বারো পেড়িয়ে তেরো তে পা দিয়েছে। তাদের স্কুলে নতুন প্রধানশিক্ষিকা এসেছেন , রমলা সেন। তিনি ফুলমনি কে দেখেন আর অবাক হন । ক্লাসে প্রথম হয়, মেধাবী, ফুলের মতনই সুন্দর এবং সরল । তার সরল কাজল টানা চোখের দিকে তাকিয়ে রমলা সেন এর বুক ব্যথায় টন টন করে ওঠে; রমলার সেনের একটি মাত্র ষোল বছরের ছেলে এক দুরারোগ্য অসুখে মারা গেছে। তিনি এখন নিঃসন্তান কিন্তু একটা কথা কেউ জানেনা, রমলা সেন, শিক্ষিতা হয়েও মেয়ে সন্তান কে ব্রাত্য মনে করে এসেছেন এতকাল। তাই তো নিজের সদ্য ভূমিষ্ঠ কন্যা সন্তান কে মাঠের পাড়ে, গাছের তলায় বর্জন করে এসেছিলেন। আজ তার প্রাণ মেয়েটিকে বুকে জরিয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। তিনি খাতা দেখে জেনেছেন মেয়েটির নাম ফুলমনি সোরেন, মানে আদি বাসী কন্যা। কিন্তু তা হতে পারেনা, এত মার্জিত, এত কাটা কাটা মুখ চোখ, চাঁপাফুল গায়ের রঙ বলে দেয় এ মেয়ে আর যাই হক আদিবাসী কন্যা নয়। রমলা সেন খোজ খবর নিয়ে জানলেন ফুলমনির মন-খুশী গ্রামের মাহিয়া সোরেন এর মেয়ে । রমলা সেনের মা এর মন, কেবলি বলে, এ মেয়ে আমার , এ মেয়ে আমার।
এক রবিবার ছুটির দুপুরে রমলা সেন গ্রামের মাহিয়ামায়ের সাথে দেখা করেন।
রমলা সেন সরল সাদা মাহিয়া মাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন ফুলমনি তার পালিতা কন্যা। তাকে কেউ গ্রামের প্রান্ত সীমায় গাছের তলায়, শীতের রাতে ফেলে গেছিল।
তিনি বললেন, এ মেয়ে তো তোমার নয়, এ আমার মেয়ে, আমাকে দিয়ে দাও, আমি পড়াব, বড় করব, তোমার কাছে থেকে কি পাবে মেয়ে?
মাহিয়া মা আর্তনাদ করে ওঠে, না না ফুলমনি আমার বুকের ধন, চোখের মনি, আমার জিগরের টুকর, আমার সহায় সম্বল, একে কেড়ে নেবেন না। মাহিয়ামারমলা সেনের পায়ে ধরে, তার চোখের জলে রমলার পা ভিজে যায় কিন্তু তাঁর মন ভেজে না।
রমলা সেন কঠিন স্বরে বলেন ভালয় ভালয় না যদি দাও আমি পুলিশে খবর দেব।
ততোক্ষণে গ্রামের লোকরা মাহিয়ামায়ের উঠানে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে, সববাইহাত জোর করে বলে, দিদিমণি আপনি বড় মানুষ স্কুলে পড়ান, আমাদের মায়ের বুক থেকে মেয়ে কেড়ে নেবেন না।
কিন্তু যখন এত কাণ্ড ঘরে তখন ফুলমনি কোথায় ? ফুলমনি দাশু মূর্মুর পেয়েরা গাছের ডালে বসে কাঁচা পেয়ারা খাচ্ছে, সঙ্গে সব গ্রামের দুরন্ত শিশু। হটাতকোথা থেকে ঘন কালো মেঘ এসে আকাশের সূর্য কে ঢেকে ফেলল। গাছের পাতা সব শান্ত হয়ে গেলো। পাখিরা ডাকা বন্ধ করে দিল, ফুলমনির পুষি কেঁদে উঠল আর দূরে কোথাও নীল পাখি ডেকে উঠল । ফুলমনি স্পষ্ট শুনতে পেল পাখি বলছে, ফুলমনি বাড়ি যাও, তোমার মায়ের বড় বিপদ। এক লাফে গাছে থেকে নেমে, হাতের আধ খাওয়া পেয়েরা ছুড়ে ফেলে মেয়ে দৌর দিল, একদমে এসে দাঁড়াল মাহিয়ার উঠানে, সেখানে সব গ্রামবাসী হতবাক দাঁড়িয়ে, আর মাহিয়ামাবোবা জন্তুরে মতন আছাড়ি বিছাড়ি খাচ্ছে। মাহিয়া তো জানে ফুলমনি নিজের মাকে খোজে, সে কি এমন মাকে ছড়ে তার কোলে আর থাকবে। হা ভগবান দিলে যদি তবে কেন কেড়ে নাও।
ফুলমনি এসে মাহিয়ামায়ের চোখ নিজের জামা দিয়ে মুছিয়ে দিল, মাকে নিজেরছোট্ট বুকে জড়িয়ে বলে উঠল, দিদিমনি আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু আর করিনা। আপনি শুধু নিষ্ঠুর নন আপনি স্বার্থপর । আমার মা আমায় মানুষ করেছে, খাইয়ে পড়িয়ে আদরে যত্নে মানুষ করেছে। আমি আমার মা আর সব গ্রামের লোককে ভালোবাসি আর শ্রদ্ধা করি। এনারা রাস্তায় পরে থাকা শিশুকেজীবন দিয়েছেন। এরা সবাই আমার পরম আত্মীয়, কাকা,কাকী, ভাই ,বন,দিদু আর দিদা। এ গ্রাম আমায় জীবন দিয়েছে, গ্রাম আমার আর আমি গ্রামের মেয়ে;আমি বড় হয়ে শিক্ষিকা হব,আর গ্রামবাসী কে শিক্ষিত করব। আপনি মেয়ে সন্তান কে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন আর আজ নিজের ছেলে হারিয়ে আমাকে দয়া দেখাতে এসেছেন । ছিঃ আপনি অমানুষ, এখুনি এখান থেকে চলে যান, না হলে আমি স্কুলে সব্বাই কে বলে দেব আমি আপনার কথা। আপনিলুকিয়ে দত্তক নিতে পারবেন না।
মাহিয়ামা আর গ্রামের যত মানুষ অবাক বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় তের বছরের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে । কোথা থেকে পেল এত শক্তি, কেমনকরে এমন কথা বলতে পারল, ফুলমনি নিজেই অবাক। রমলা সেন যথেষ্ট অপমানিত হয়ে গ্রাম ছাড়লেন আর কিছুদিনের মধ্যে স্কুল ও ছেড়ে দিলেন।
এখন রাত বারটা, সারা গ্রাম ঘুমে আচ্ছন্ন, ফুলমনি পা টিপে টিপে বাইরে আকাশের তলায় এসে দাঁড়াল। নীল পাখি কে আর জিজ্ঞাসা করার কিছু নেই, কে তার আসল মা। নিজের জন্মদাত্রীকে দেখে বিতৃষ্ণা, বিদ্বেষ আর বেদনায় তার কোমল বুক মুচরে মুচড়ে উঠছে। এমন সময় মাহিয়া মায়ের ডাক রাত্রির অন্ধকার আর নৈশব্দ কে ফালা ফালা করে দিল- ফুলমনি মা আমার, কৈ গেলি মা, বুকে আয় মা, ঘুমাবি আমার বুকে। ফুলমনি মনে হল ঠিক যেন নীল পাখিরডাক, তেমনি সুরেলা, তেমনি মায়াময়, তেমনি সুতীব্র। ফুলমনি তার ভাঙ্গা মাটির ঘরে এসে শান্ত আর নিশ্চিন্ত হৃদয়ে মায়ের পাশে টিতে, মাকে জড়িয়ে পরম সুখে ঘুম গেল।